চান্দ্রা বাজার নূরিয়া ফাযিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসা

আমাদের ওয়েবসাইটে আপনাকে স্বাগতম, পরিদর্শন করার জন্য ধন্যবাদ

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম

চান্দ্রা বাজার নূরীয়া ফাযিল  (ডিগ্রি) মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ মৌলভী নূর বক্স (রহ.) এর   জীবন ও কর্মঃ

ভূমিকাঃ বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলের গুণীজনদের মধ্যে চাঁদপুর জেলার নূর বক্স (রহ..) হুজুর অন্যতম। ১৭৫৭ সালের পলাশীর আম্রকাননে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পতনের পর থেকে এদেশের ইসলামি তাহযিব-তামাদ্দুন ও নৈতিক আদর্শের অধঃপতন শুরু হয়। ক্রমেই অবস্থা এমন পর্যায়ে পৌঁছে যে, মুসলমানগণ তাদের স্বকীয় কৃষ্টি সভ্যতা, ইতিহাস ও ঐতিহ্য ভুলে অধঃপতনের গভীর অন্ধকারে নিমজ্জিত হওয়ার উপক্রম হয়েছিল। মুসলমানদের এই ক্রান্তিলগ্নে যে কয়েকজন আলেমে রব্বানী শিক্ষার মাধ্যমে যুগের হাল ধরেন তাদের মধ্যে আল্লামা নূর বক্স (রহ.) অন্যতম।

জন্মকাল ও জন্মস্থানঃ

মুসলমানদের সামাজিক এই অবক্ষয়ের সময় অবিভক্ত বাংলার অন্তর্গত তৎকালীন ত্রিপুরা (কুমিল্লা) জেলাধীন (বর্তমান চাঁদপুর জেলার চাঁদপুর সদর থানা) ১২ নং চান্দ্রা ইউনিয়নের বাখরপুর গ্রামে নানা মনিরুদ্দীন পাটোয়ারীর ঘরে জন্মগ্রহণ করেন।

আনুমানিক জন্ম সাল ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দ। তাঁর পিতা মরহুম মৌলভী সুফী ওসমান আলী মিয়াজী যিনি ইলমি শরীয়ত ও ইলমি মা’রেফাতের একজন অতি উচ্চ মাকামের বুজুর্গ ছিলেন। কথিত আছে যে, তার ইমামতিতে জ্বিনেরা সালাত আদায় করতো। তাঁর মাতার নাম আছিয়া খাতুন।  

শৈশবকালঃ

শৈশবকাল হতেই আল্লামা নূর বক্স (রহ.) ব্যতিক্রমী ছিলেন। খেলাধুলা বা হাসি তামাশা করে সময় কাটানো আদৌ পছন্দ করতেন না। ছোটবেলা থেকেই তিনি বিস্ময়কর স্মৃতিশক্তির অধিকারী ছিলেন। বাবার হাতেই তার প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি হয়।  

শিক্ষাজীবনঃ

ইসলামি জ্ঞান অর্জনের মহান নিয়তে তিনি প্রাথমিক শিক্ষা সমাপ্ত করে তৎকালীন চাঁদপুর অঞ্চলে বড় কোনো মাদ্রাসা না থাকায় উচ্চতর জ্ঞান অর্জনের নিমিত্তে কলকাতায় গিয়ে কলকাতা আলিয়া মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে প্রায় ১৫ বছর লেখাপড়া করেন।  

মৌলভী নূর বক্স (রহ.) দেশ-বিদেশে অসংখ্য বুজুর্গ ওস্তাদগণের নিকট শিক্ষা লাভ করেন। তাদের মধ্যে অন্যতম শামসুল উলামা খাজা কামাল উদ্দিন আহমদ। যিনি কলকাতা আলিয়ার ২৬ জন ইংরেজ অধ্যক্ষের পরে সর্বপ্রথম মুসলমান অধ্যক্ষ হিসেবে কলকাতা আলিয়ায় যোগদান করেন। এছাড়াও আল্লামা মোশতাক আহমাদ ও শামসুল ইসলাম, আল্লামা নেছার উদ্দিন (রহ.) এবং মোক্তার আহমাদ অন্যতম। পরবর্তীতে তিনি তার প্রিয় ওস্তাদগণের দোয়া ও স্মৃতির অংশ হিসেবে নিজ ছেলেদের নাম রাখেন।

চান্দ্রা নূরীয়া মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠা ও কর্মজীবনঃ

কলকাতা আলিয়া হতে শিক্ষাজীবন সমাপ্ত করার পর তিনি অবিভক্ত বাংলায় ফিরে এসে বাংলার পূণ্যভূমি সিলেটে শিক্ষকতা পেশার মাধ্যমে কর্মজীবন শুরু করেন। প্রায় এক বছর সেখানে খেদমতের পর ওস্তাদদের পরামর্শে নিজ এলাকাকে কোরআনের আলোকে আলোকিত করতে জন্মভূমিতে ফিরে আসেন। স্থানীয় মুরুব্বিদের সহযোগিতায় ১৯০২ সালে প্রতিষ্ঠিত করেন আজকের দক্ষিণ বাংলার ঐতিহ্যবাহী দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চান্দ্রা বাজার নূরীয়া ফাযিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসা। তিনি আমৃত্যু প্রায় ৫৪ বছর এই প্রতিষ্ঠানের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। নূরীয়া অর্থাৎ উনার নিজ নামের অংশ যুক্ত করে মাদ্রাসার নামকরণ করে প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু করেন। পরবর্তীতে উনার ইন্তেকালের পরে মাদ্রাসার কোনো এক বার্ষিক মাহফিলে তৎকালীন ছারছীনা দরবার শরীফের পীরে কামেল আল্লামা শাহ সুফি আবু জাফর মোহাম্মদ সালেহ (রহ.) কে প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ করা হয়। হুজুরের উপস্থিতিতে মাদ্রাসার নামের আংশিক পরিবর্তন করে নতুন নামকরণের প্রস্তাব করা হয় এভাবে যে,”চান্দ্রা বাজার নূরীয়া ছালেহিয়া মাদ্রাসা”। তখন শরীয়ত ও মা’রেফতের বুজুর্গ পীরে কামেল জানতে চান এই নূরীয়া (নূর বক্স) উনি কে?তখন রামপুরের মাওলানা আব্দুর রহমান সাহেব বললেন, উনি এই মাদ্রাসার প্রতিষ্ঠাতা। তবে উনার আরো একটি পরিচয় রয়েছে-সেটা হলো, আপনাদের মাদ্রাসার মুহাদ্দিস ইউনুস আলী সাহেবের ওস্তাদ ছিলেন নূর বক্স (রহ.)। সাথে সাথে পীরে কামেল আদেশ করে বললেন, মাওলানা ইউনুস আলী সাহেব আমার ওস্তাদ ছিলেন। যেখানে আমার ওস্তাদের ওস্তাদের নাম যুক্ত করে মাদ্রাসার নাম রাখা হয়েছে সেখানে আমার নামের সংযুক্তির প্রয়োজন নেই। আমি বরং দোয়া করে দেই এই প্রতিষ্ঠানকে যেন আল্লাহ তায়ালা দ্বীনের সূতিকাগার হিসেবে কবুল করেন। এমনকি যে সাইনবোর্ডে হুজুরের নামের অংশ সংযুক্ত করা হয়েছিল (ছালেহিয়া) তা হুজুর নিজ হাতে কেটে দেন এবং বরকতের জন্য মাদ্রাসার উত্তরে বর্তমান মসজিদ সংলগ্ন টিনের বেড়ায় কাঠের পিলার নিজ হাতে লাগিয়ে দেন। এভাবেই শুধু প্রতিষ্ঠাতা নূর বক্স (রহ.) নাম ধরেই চান্দ্রা বাজার নূরীয়া ফাযিল  (ডিগ্রি) মাদ্রাসা কালের সাক্ষী হয়ে আছে।

পারিবারিক জীবনঃ

মৌলভী নূর বক্স (রহ.) ব্যক্তিজীবনে চার পুত্র ও দুই কন্যার জনক ছিলেন।

তরিকার সবক গ্রহণঃ

তৎকালীন সময়ের জৈনপুরী খানদানের অন্যতম আধ্যাত্মিক রাহবার শাহ সুফি আব্দুর রব জৈনপুরীর সান্নিধ্যে গিয়ে হুজুরের আমল আখলাক দেখে মুগ্ধ হন এবং হুজুর উনাকে দেখে নেক নজরে নিয়ে বাইয়াত করান।

ইসলামের খেদমতে আত্মনিয়োগঃ

মৌলভী নূর বক্স (রহ.) শিক্ষকতা জীবনে ব্যাপক খ্যাতি অর্জন করেন। অল্প সময়ের মধ্যেই প্রতিষ্ঠানের সুখ্যাতি চারদিকে ছড়িয়ে পড়লে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল হতে ছাত্ররা এসে প্রতিষ্ঠানে ভর্তি হতে লাগলো। প্রায় চারশতাধিক ছাত্র একসাথে লেখাপড়া করতেন। কথিত আছে, উনার পশ্চিম বাখরপুরে ১৪৪ শতাংশের এক খন্ড জমি ছিল। চৈত্র মাসের খরতাপে মাটি শক্ত ও চাকা হয়ে গিয়েছিল। ক্লাসে একদিন তিনি প্রসঙ্গক্রমে বললেন, এতো বড় জমি ফসল উপযোগী করা যাবে কীভাবে! পরের দিন খবর আসলো- এক রাতেই ছাত্ররা পুরো ক্ষেত পিটিয়ে মাটির চাকা ভেঙ্গে ফসল উপযোগী করে দিয়েছে।

উল্লেখযোগ্য ছাত্রগণঃ

উনার ছাত্রদের মধ্যে অনেকেই মুহাদ্দিস, মুফাসসির ও ফকিহ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। জনশ্রুতি আছে যে, উনার ছাত্রদের মধ্যে সারাদেশে একই সময়ে ২৬ জন অধ্যক্ষ বা প্রতিষ্ঠান প্রধান ছিলেন। অনেকেই নিজ হাতে স্বতন্ত্র প্রতিষ্ঠান গড়ে ইসলামের খেদমত করে গেছেন। বিদগ্ধ এই গুণী শিক্ষকের ছোঁয়ায় অসংখ্য গুণীজন তৈরি হয়েছে যাদের সবার পরিচয় দেওয়া সম্ভব নয়। তবে উল্লেখযোগ্য হলেন- হযরত মাওলানা ইউনুস আলী সাহেব (সাবেক মুহাদ্দিস- ছারছিনা দারুসুন্নাত নেছারিয়া কামিল মাদ্রাসা), মাওলানা আব্দুল গনি (রহ.) (পীর সাহেব মাদারীপুর), মোহাম্মদ আলী সাহেব (রহ.) (উপাধ্যক্ষ ওসমানিয়া কামিল মাদ্রাসা), আব্দুল হাই সাহেব (রহ.) (অধ্যক্ষ, চান্দ্রা বাজার নূরীয়া ফাযিল  (ডিগ্রি) মাদ্রাসা।

ইংরেজ বিরোধী আন্দোলনে অবদানঃ

মৌলভী নূর বক্স (রহ.) বরাবরই চরমপন্থার বিরুদ্ধে অবস্থান গ্রহণ করতেন। সন্ত্রাসবাদকে তিনি মনে প্রাণে ঘৃণা করতেন। সমাজ বা রাষ্ট্রে সংঘটিত যে কোন খারাপ কর্মের বিরুদ্ধে নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলনের আয়োজন করতেন। ‘সংঘাত নয়, শান্তি’ এটাই ছিল হুজুরের মূলনীতি। বিশেষ করে তিনি ইংরেজদের শোষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে আপোসহীন নিরলস সংগ্রাম করে গেছেন।

সামাজিক অবদানঃ

সমাজ সংস্কারে বিশেষ করে শিরক বিদআতের ব্যাপারে তিনি বজ্র কঠোর ছিলেন। ১৯৪৭ এ দেশভাগের পূর্বে তৎকালীন ভারতবর্ষ ও বাংলাদেশ জুড়ে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গায় গণহত্যা, ধর্ষণ, অপহরণ ও অগ্নিসংযোগের মত ঘটনা ঘটে। এই দাঙ্গার রেশ ধরে দক্ষিণ পূর্বাঞ্চল হতে প্রায় দুই থেকে আড়াই হাজার লোক মদনা, দক্ষিণ বালিয়া ও বাখরপুর গ্রামে লুটতরাজ অপহরণ ও ধর্মান্তকরণের জন্য আসে। তখন মৌলভী নূর বক্স (রহ.) এর প্রত্যক্ষ নেতৃত্বে এলাকার মুরুব্বী ও যুবকদের নিয়ে হামলা রুখে দিয়ে শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন। এভাবে দুইবার হামলার পরিকল্পনা করা হয়। প্রতিবারই তাদের হামলা রুখে দেওয়া হয়। তাই তৎকালে সময়ের এই অঞ্চলে বসবাসকারী হিন্দুরা হুজুরকে বিশেষ সম্মান দিতেন। এর কারণও ছিল। একবার দক্ষিণের চরাঞ্চলের কিছু দুষ্কৃতিকারী দক্ষিণ বালিয়া মজুমদার বাড়িতে হামলা করে হিন্দু মেয়েদের জোরপূর্বক উঠিয়ে নিয়ে মসজিদে বিয়ের আয়োজন করে। হিন্দুদের পালিত গরু জবাই করে খাওয়ার ব্যবস্থা করে। এ সংবাদ অবহিত হয়ে মৌলভী নূর বক্স (রহ.) মরহুম আমিনুদ্দিন পাটোয়ারী, মরহুম খলিলুর রহমান পাটোয়ারী, মরহুম ওয়ালিউল্লাহ পাটোয়ারীসহ আরো স্থানীয় লোকজনদের সহযোগিতায় হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রতি এই অমানবিক অন্যায়ের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। যে কাজী বিয়ে পড়াতে গিয়েছিল তাকে থাপ্পড় দিয়ে মসজিদ থেকে বের করে দেন এবং হুজুর বজ্রকন্ঠে বলেন হিন্দুর সাথে মুসলিমের বিয়ে জায়েজ কোন কিতাবে পেয়েছো? শেষ পর্যন্ত দুষ্কৃতিকারীরা পলায়ন করতে বাধ্য হয়। এভাবেই তিনি শান্তি প্রতিষ্ঠা করেন।

আমল আখলাকঃ

লেবাস পোশাক, চালচলন, খাওয়া দাওয়া, আমল আখলাক, মুয়ামালাত-মুয়াশারাত জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সুন্নতের পাবন্দ ছিলেন তিনি। অত্যন্ত কঠোর আপোসহীন ছিলেন। ফরজ, ওয়াজিব, সুন্নাতে মুয়াক্কাদা তো বটেই নফল-মুস্তাহাবের আমল তরক করা থেকে বিরত থাকতেন। এই কারণে ওনার চারিত্রিক গুণাবলীতে মুগ্ধ হয়ে পাটোয়ারী বাড়ির মুরুব্বিরা মাদ্রাসার জন্য বিশাল জমি ওয়াকফ করে দিয়েছিলেন।

ইন্তেকালঃ

১৯৫৪ সালে এ ক্ষণজন্মা মহাপুরুষের কর্মময় জীবনের ইতি ঘটে। বাংলা কার্তিক মাসের চরম বর্ষার সময়ে ৯০ বছর বয়সে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। ইন্নালিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন। বর্ষাকাল থাকার কারণে পাটোয়ারী বাড়ির মুরুব্বিদের অনুরোধে উনাকে পাটোয়ারী বাড়িতেই দাফন করা হয়। আল্লাহ তা’আলা তাঁকে এবং যাদের জমিতে মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে সকল শুভানুধ্যায়ীদের জান্নাতের উঁচু মাকাম দান করুন, আমিন।